USG OF W/A টেস্ট কী: পেটের আল্ট্রাসাউন্ড
পেটের আল্ট্রাসাউন্ড: USG OF W/A টেস্ট নিয়ে আপনার যা জানা দরকার
আচ্ছা, পেটের ভেতরটা যদি দেখা যেত, কেমন হতো বলুন তো? কোনো যন্ত্র ছাড়াই যদি শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ঝটপট দেখে নেয়া যেত, তাহলে রোগ নির্ণয় করা কতোটা সহজ হয়ে যেত, তাই না? ঠিক এই কাজটাই করে আলট্রাসনোগ্রাফি। USG of W/A (আলট্রাসনোগ্রাফি অফ হোল অ্যাবডোমেন) হলো পেটের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যেমন – লিভার, কিডনি, পিত্তথলি, অগ্ন্যাশয় এবং প্লীহা ইত্যাদি পরীক্ষা করার একটি আধুনিক পদ্ধতি।
২. USG OF W/A টেস্ট কী?
USG of W/A, মানে হলো পেটের আলট্রাসনোগ্রাফি। এটা এমন একটা পরীক্ষা, যেখানে শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে পেটের ভেতরের ছবি তোলা হয়। অনেকটা যেন পেটের একটা লাইভ ভিডিও দেখা! এই পরীক্ষায় কোনো রকম রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় না, তাই এটা শরীরের জন্য খুবই নিরাপদ। পেটের কোনো সমস্যা হলে ডাক্তাররা প্রায়ই এই পরীক্ষাটি করতে বলেন।
২.১ কেন এই পরীক্ষা করা হয়?
পেটের আলট্রাসনোগ্রাফি করার অনেক কারণ থাকতে পারে। নিচে কয়েকটি প্রধান কারণ উল্লেখ করা হলো:
- পেটে ব্যথা: পেটে ব্যথার কারণ খুঁজে বের করতে এই পরীক্ষাটি করা হয়। ব্যথার উৎস এবং তীব্রতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
- অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আকার দেখা: লিভার, কিডনি, পিত্তথলি, অগ্ন্যাশয় এবং প্লীহার আকার এবং গঠন কেমন আছে, তা জানতে এই পরীক্ষা করা হয়।
- টিউমার বা সিস্ট নির্ণয়: পেটের ভেতরে কোনো টিউমার বা সিস্ট আছে কিনা, তা এই পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই বোঝা যায়।
- পাথরের সন্ধান: পিত্তথলি বা কিডনিতে পাথর হয়েছে কিনা, তা দেখার জন্য আলট্রাসনোগ্রাফি করা হয়।
- পেটে পানি জমা: পেটে পানি জমলে (অ্যাসাইটিস) তা কতটা আছে এবং কেন হয়েছে, তা জানার জন্য এই পরীক্ষা করা হয়।
২.২ এই পরীক্ষার সুবিধা কী?
পেটের আলট্রাসনোগ্রাফির অনেক সুবিধা রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলো:
- নিরাপদ: এই পরীক্ষায় রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় না, তাই এটি শরীরের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ।
- ব্যথাহীন: আলট্রাসনোগ্রাফি করার সময় কোনো রকম ব্যথা লাগে না।
- দ্রুত: খুব অল্প সময়ে এই পরীক্ষা করা সম্ভব। সাধারণত ১৫-২০ মিনিট সময় লাগে।
- সহজলভ্য: এটি প্রায় সব হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই পাওয়া যায়।
- কম খরচ: অন্যান্য ইমেজিং পদ্ধতির তুলনায় এটি বেশ সাশ্রয়ী।
৩. পরীক্ষার আগে কী প্রস্তুতি নিতে হয়?
আলট্রাসনোগ্রাফি করার আগে কিছু প্রস্তুতি নেয়া ভালো, যাতে পরীক্ষার ফলাফল নির্ভুল হয়।
৩.১ কী কী খাবার খাওয়া উচিত না?
আলট্রাসনোগ্রাফি করার আগে সাধারণত কিছু খাবার খেতে নিষেধ করা হয়, কারণ কিছু খাবার পেটে গ্যাস তৈরি করতে পারে, যা পরীক্ষার ছবিকে অস্পষ্ট করে দিতে পারে। সাধারণত যে খাবারগুলো নিষেধ করা হয়:
- ডাল ও বিচি জাতীয় খাবার: মটর, মুসুর, ছোলা ইত্যাদি গ্যাস তৈরি করে।
- শাক: কিছু শাক, যেমন – বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রোকলি ইত্যাদি গ্যাস তৈরি করতে পারে।
- ফাস্ট ফুড ও তৈলাক্ত খাবার: এই ধরনের খাবার হজম হতে সময় নেয় এবং গ্যাস তৈরি করতে পারে।
- সফট ড্রিঙ্কস: এগুলোতে কার্বন ডাই অক্সাইড থাকে, যা পেটে গ্যাস তৈরি করে।
৩.২ কতক্ষণ আগে খাবার বন্ধ করতে হয়?
আলট্রাসনোগ্রাফি করার কমপক্ষে ৬-৮ ঘণ্টা আগে খাবার বন্ধ করা উচিত। এর ফলে পেটে গ্যাস তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং ছবি তোলার সময় সবকিছু পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। তবে, পরীক্ষার আগে অল্প পরিমাণে পানি পান করা যেতে পারে।
৩.৩ আর কী কী প্রস্তুতি নিতে হয়?
- ডাক্তারের পরামর্শ: আপনার যদি কোনো বিশেষ শারীরিক সমস্যা থাকে বা আপনি যদি কোনো ওষুধ খেয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই ডাক্তারকে জানান।
- পোশাক: পরীক্ষার সময় পেটের জামাকাপড় সরাতে হতে পারে, তাই ঢিলেঢালা পোশাক পরে যাওয়া ভালো।
- গয়না: পেটের आसपास কোনো গয়না থাকলে তা খুলে ফেলুন।
৪. USG OF W/A কিভাবে করা হয়?
আলট্রাসনোগ্রাফি করার পদ্ধতিটি খুবই সহজ এবং সাধারণত ১৫-২০ মিনিট সময় লাগে।
৪.১ পরীক্ষার পদ্ধতি
- প্রস্তুতি: প্রথমে রোগীকে পরীক্ষার টেবিলে শুতে বলা হয়। পেটের জামাকাপড় সরিয়ে পেটের অংশটি পরিষ্কার করা হয়।
- জেল লাগানো: এরপর পেটে একটি বিশেষ জেল লাগানো হয়। এই জেলটি শব্দ তরঙ্গকে ভালোভাবে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।
- ট্রান্সডুসার ব্যবহার: একজন টেকনিশিয়ান ট্রান্সডুসার নামক একটি ছোট যন্ত্র পেটের উপর রাখেন এবং ধীরে ধীরে ঘোরান। এই যন্ত্রটি শব্দ তরঙ্গ পাঠায় এবং প্রতিধ্বনি গ্রহণ করে কম্পিউটারে ছবি তৈরি করে।
- ছবি তোলা: কম্পিউটারে পেটের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর ছবি দেখা যায়। টেকনিশিয়ান বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তোলেন, যাতে সবকিছু ভালোভাবে দেখা যায়।
৪.২ পরীক্ষার সময় কেমন অনুভূতি হয়?
আলট্রাসনোগ্রাফি করার সময় কোনো রকম ব্যথা বা অস্বস্তি হয় না। তবে, পেটের উপর যখন ট্রান্সডুসার ঘোরানো হয়, তখন হালকা চাপ লাগতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে জেলটি ঠান্ডা লাগতে পারে, তবে এটি ক্ষণস্থায়ী।
৫. পরীক্ষার ফলাফল
আলট্রাসনোগ্রাফির ফলাফল পাওয়ার পরে, ডাক্তার সেই ছবিগুলো ভালোভাবে দেখেন এবং একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। এই রিপোর্টে পেটের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর আকার, গঠন এবং কোনো অস্বাভাবিকতা থাকলে তা উল্লেখ করা হয়।
৫.১ রিপোর্টের মানে কী?
রিপোর্টে বিভিন্ন ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়, যা হয়তো আপনার কাছে অপরিচিত লাগতে পারে। এখানে কয়েকটি সাধারণ শব্দ এবং তাদের মানে উল্লেখ করা হলো:
- নরমাল: এর মানে হলো আপনার পেটের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো স্বাভাবিক আছে এবং কোনো সমস্যা নেই।
- হেপাটোমেগালি: এর মানে হলো লিভারের আকার স্বাভাবিকের চেয়ে বড়।
- স্প্লেনোমেগালি: এর মানে হলো প্লীহার আকার স্বাভাবিকের চেয়ে বড়।
- হাইড্রোনেফ্রোসিস: এর মানে হলো কিডনিতে পানি জমেছে।
- কোলেলিথিয়াসিস: এর মানে হলো পিত্তথলিতে পাথর আছে।
৫.২ ডাক্তারের পরামর্শ
আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। ডাক্তার আপনার রিপোর্ট দেখে এবং আপনার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেবেন। অনেক সময়, রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে আরও কিছু পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে।
৬. USG OF W/A এবং অন্যান্য পরীক্ষা
পেটের সমস্যার জন্য আরও অনেক ধরনের পরীক্ষা করা হয়। আলট্রাসনোগ্রাফির সাথে অন্য পরীক্ষার পার্থক্য নিচে দেওয়া হলো:
৬.১ এক্স-রে (X-ray)
এক্স-রে একটি ইমেজিং পরীক্ষা, যেখানে রেডিয়েশন ব্যবহার করে শরীরের ভেতরের ছবি তোলা হয়। এটি সাধারণত হাড়ের সমস্যা দেখার জন্য ব্যবহার করা হয়। পেটের সমস্যা নির্ণয়ের জন্য আলট্রাসনোগ্রাফি বেশি উপযোগী, কারণ এটি নরম টিস্যু এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে ভালোভাবে দেখাতে পারে।
৬.২ সিটি স্ক্যান (CT Scan)
সিটি স্ক্যান হলো একটি উন্নত ইমেজিং পরীক্ষা, যেখানে এক্স-রে ব্যবহার করে পেটের বিস্তারিত ছবি তোলা হয়। এটি আলট্রাসনোগ্রাফির চেয়ে বেশি তথ্য দিতে পারে, তবে এতে রেডিয়েশনের ব্যবহার বেশি। টিউমার, সংক্রমণ বা রক্তক্ষরণ নির্ণয়ের জন্য সিটি স্ক্যান ব্যবহার করা হয়।
৬.৩ এমআরআই (MRI)
এমআরআই হলো ম্যাগনেটিক ফিল্ড এবং রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে শরীরের ভেতরের ছবি তোলার একটি পদ্ধতি। এটি সিটি স্ক্যানের চেয়েও বেশি বিস্তারিত ছবি দিতে পারে এবং এতে কোনো রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় না। লিভার, কিডনি এবং অন্যান্য নরম টিস্যুর সমস্যা নির্ণয়ের জন্য এমআরআই খুব উপযোগী।
৬.৪ কোন পরীক্ষাটি আপনার জন্য ভালো?
কোন পরীক্ষাটি আপনার জন্য সবচেয়ে ভালো, তা নির্ভর করে আপনার সমস্যার ধরনের উপর। আপনার ডাক্তার আপনার শারীরিক অবস্থা এবং লক্ষণের উপর ভিত্তি করে সঠিক পরীক্ষাটি নির্বাচন করবেন।
৭. গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি
গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এটি মায়ের পেটের ভেতরের বাচ্চার স্বাস্থ্য এবং বিকাশের অবস্থা জানতে সাহায্য করে।
৭.১ কেন করা হয়?
গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি করার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো:
- বাচ্চার বয়স নির্ধারণ: আলট্রাসনোগ্রাফি করে বাচ্চার সঠিক বয়স জানা যায়, যা ডেলিভারির তারিখ নির্ধারণে সাহায্য করে।
- বাচ্চার অবস্থান দেখা: বাচ্চা পেটের ভেতরে কোন অবস্থানে আছে, তা জানা যায়।
- বাচ্চার বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ: বাচ্চার বৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে কিনা, তা দেখা হয়।
- জন্মগত ত্রুটি নির্ণয়: বাচ্চার কোনো জন্মগত ত্রুটি আছে কিনা, তা আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে জানা যায়।
- একাধিক বাচ্চা: পেটে একটির বেশি বাচ্চা আছে কিনা, তা এই পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়।
৭.২ কতবার করা উচিত?
গর্ভাবস্থায় সাধারণত ২-৩ বার আলট্রাসনোগ্রাফি করার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রথমটি সাধারণত প্রথম তিন মাসে (১২-১৪ সপ্তাহের মধ্যে), দ্বিতীয়টি পাঁচ মাসের সময় (১৮-২০ সপ্তাহের মধ্যে) এবং তৃতীয়টি শেষের দিকে করা হয়। তবে, কোনো জটিলতা থাকলে ডাক্তার আরও বেশিবার আলট্রাসনোগ্রাফি করতে বলতে পারেন।
৮. কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
৮.১ USG OF W/A করতে কি খালি পেটে থাকতে হয়?
হ্যাঁ, সাধারণত USG of W/A করার আগে ৬-৮ ঘণ্টা খালি পেটে থাকতে হয়। এর ফলে পেটে গ্যাস কম হয় এবং ছবি তোলার সময় সবকিছু পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।
৮.২ USG OF W/A রিপোর্টে কি সব রোগ ধরা পরে?
USG of W/A একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হলেও, এটি সব রোগ নির্ণয় করতে পারে না। এটি পেটের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর একটি সাধারণ চিত্র দেয়। কিছু বিশেষ রোগ নির্ণয়ের জন্য আরও উন্নত পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।
৮.৩ USG OF W/A এর খরচ কেমন?
USG of W/A এর খরচ সাধারণত ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এটি নির্ভর করে ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং শহরের উপর।
৮.৪ USG OF W/A কি ক্ষতিকর?
না, USG of W/A কোনো ক্ষতিকর পরীক্ষা নয়। এটিতে কোনো রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় না, তাই এটি শরীরের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ।
৮.৫ পেটে গ্যাসের কারণে কি USG করা যায় না?
পেটে অতিরিক্ত গ্যাস থাকলে USG এর ছবি অস্পষ্ট হতে পারে। তাই, পরীক্ষার আগে গ্যাস হয় এমন খাবার এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
৯. USG OF W/A: আপনার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
USG of W/A একটি নিরাপদ এবং গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা, যা পেটের ভেতরের বিভিন্ন সমস্যা নির্ণয় করতে সাহায্য করে। পেটে কোনো ধরনের অস্বস্তি বা সমস্যা হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করান। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন!
১০. শেষ কথা
তাহলে, USG of W/A নিয়ে আপনার মনে যে প্রশ্নগুলো ছিল, আশা করি তার উত্তর দিতে পেরেছি। মনে রাখবেন, স্বাস্থ্য আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই, কোনো সমস্যা হলে অবহেলা না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন। আর হ্যাঁ, এই লেখাটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আপনার একটি শেয়ার হয়তো অনেকের উপকারে আসতে পারে। সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন!
