SGPT টেস্ট কেন করা হয়: লিভার স্বাস্থ্য পরীক্ষা
লিভারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা: SGPT টেস্ট কেন করা হয়?
আচ্ছা, কেমন হয় যদি আপনার শরীরের ভেতরের কলকব্জাগুলোর একটা হেলথ রিপোর্ট আপনি নিয়মিত হাতে পান? অনেকটা সেরকমই একটা ব্যাপার হলো SGPT (Serum Glutamic Pyruvic Transaminase) টেস্ট। এইটা লিভারের স্বাস্থ্য পরীক্ষার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভাবছেন, কেন এই টেস্টটা করা হয়? তাহলে চলুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক!
লিভার আমাদের শরীরের একটা পাওয়ার হাউস। এটা খাবার হজম করতে, শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করতে এবং আরও অনেক জরুরি কাজ করতে সাহায্য করে। তাই লিভার সুস্থ রাখাটা খুব দরকার।
SGPT কি এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
SGPT হলো এক প্রকারের এনজাইম, যা লিভারের কোষে পাওয়া যায়। যখন লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন এই এনজাইম রক্তে মিশে যায়। রক্তের SGPT-এর মাত্রা পরীক্ষা করে লিভারের স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। এই এনজাইমটিকে ALT (Alanine Aminotransferase) নামেও ডাকা হয়।
SGPT টেস্ট কেন করা হয়?
SGPT টেস্ট করার প্রধান কারণগুলো হলো:
- লিভারের রোগের প্রাথমিক সনাক্তকরণ: লিভারের সামান্য সমস্যা শুরু হলেই SGPT-এর মাত্রা বেড়ে যায়। তাই, রোগের শুরুতে এই টেস্টের মাধ্যমে জানা যায়।
- লিভারের ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়: SGPT-এর মাত্রা দেখে লিভারের কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা বোঝা যায়।
- চিকিৎসার কার্যকারিতা মূল্যায়ন: লিভারের রোগের চিকিৎসা শুরু করার পর, SGPT-এর মাত্রা কমে গেলে বোঝা যায় যে চিকিৎসা সঠিক পথে চলছে।
- অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে লিভারের অবস্থা জানা: কিছু কিছু রোগ, যেমন – ডায়াবেটিস বা স্থূলতা, লিভারের উপর প্রভাব ফেলে। সেক্ষেত্রে SGPT টেস্ট লিভারের অবস্থা জানতে সাহায্য করে।
কখন SGPT টেস্ট করার প্রয়োজন হতে পারে?
কিছু লক্ষণ দেখলে বোঝা যায় যে SGPT টেস্ট করানো দরকার। যেমন:
- ক্লান্তি: অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বল লাগা লিভারের সমস্যার একটা লক্ষণ হতে পারে।
- জন্ডিস: ত্বক ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া (জন্ডিস) লিভারের সমস্যার কারণে হতে পারে।
- পেটে ব্যথা: পেটের ডান দিকে বা মাঝখানে ব্যথা অনুভব করা।
- বমি বমি ভাব: लगातार বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া।
- অরুচি: खाने के प्रति अनिच्छा বা भूख কমে যাওয়া।
- প্রস্রাবের রং গাঢ় হওয়া: প্রস্রাবের রং যদি স্বাভাবিকের চেয়ে গাঢ় হয়।
- পায়খানার রং ফ্যাকাশে হওয়া: পায়খানার রং স্বাভাবিক না থাকলে।
যদি এই লক্ষণগুলোর মধ্যে কোনোটা আপনার মধ্যে দেখা যায়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
SGPT স্বাভাবিক মাত্রা এবং তার ব্যাখ্যা
SGPT-এর স্বাভাবিক মাত্রা সাধারণত পুরুষদের জন্য 7 থেকে 56 U/L (ইউনিট প্রতি লিটার) এবং মহিলাদের জন্য 7 থেকে 35 U/L ধরা হয়। তবে, এই মাত্রা স্থান, বয়স এবং পরীক্ষাগারের পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।
SGPT মাত্রা বেশি হওয়ার কারণ
SGPT-এর মাত্রা বেশি হওয়ার কিছু সাধারণ কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- লিভারের প্রদাহ (Hepatitis): ভাইরাল হেপাটাইটিস (যেমন – হেপাটাইটিস এ, বি, সি) অথবা অন্য কোনো কারণে লিভারে প্রদাহ হলে SGPT বাড়ে।
- অতিরিক্ত মদ্যপান: অতিরিক্ত মদ্যপান লিভারের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে SGPT-এর মাত্রা বেড়ে যায়।
- ফ্যাটি লিভার: লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমলে (ফ্যাটি লিভার) SGPT বাড়তে পারে।
- কিছু ঔষধ: কিছু ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে লিভারের ক্ষতি হতে পারে এবং SGPT বাড়তে পারে।
- পিত্তথলির সমস্যা: পিত্তথলিতে পাথর বা অন্য কোনো সমস্যার কারণে লিভারের কার্যকারিতা ব্যাহত হলে SGPT বাড়তে পারে।
SGPT মাত্রা কম হওয়ার কারণ
SGPT-এর মাত্রা খুব কম হওয়াটা সাধারণত উদ্বেগের কারণ নয়। তবে, কিছু ক্ষেত্রে এটি ভিটামিন বি৬-এর অভাব অথবা মারাত্মক লিভারের ক্ষতির কারণে হতে পারে।
কিভাবে SGPT টেস্টের জন্য প্রস্তুতি নেবেন?
SGPT টেস্টের জন্য বিশেষ কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। তবে, কিছু বিষয় মনে রাখা ভালো:
- ডাক্তারকে আপনার স্বাস্থ্য বিষয়ক সব তথ্য দিন: আপনি যদি কোনো ওষুধ খেয়ে থাকেন, তাহলে সে বিষয়ে ডাক্তারকে জানান। কিছু ওষুধ SGPT-এর মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে।
- খাবার: সাধারণত এই টেস্টের আগে উপোস থাকার প্রয়োজন নেই। তবে, আপনার ডাক্তার যদি অন্য কোনো পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটা মেনে চলুন।
- মানসিক প্রস্তুতি: টেস্টের আগে शांत থাকুন। দুশ্চিন্তা করলে ফলাফলে প্রভাব পড়তে পারে।
SGPT টেস্টের পদ্ধতি
SGPT টেস্টের পদ্ধতি খুবই সহজ। এটি একটি সাধারণ রক্ত পরীক্ষা।
- রক্ত সংগ্রহ: একজন স্বাস্থ্যকর্মী আপনার হাতের শিরা থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করবেন।
- নমুনা প্রক্রিয়াকরণ: রক্তের নমুনা একটি টিউবে সংগ্রহ করে তা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়।
- ফলাফল: পরীক্ষাগারে SGPT-এর মাত্রা মাপা হয় এবং রিপোর্ট তৈরি করা হয়। এই রিপোর্ট আপনার ডাক্তারকে দেওয়া হয়।
টেস্টের সময় কি আশা করা যায়?
রক্ত নেওয়ার সময় সামান্য অস্বস্তি হতে পারে। তবে, এটি খুবই দ্রুত হয় এবং সাধারণত কোনো সমস্যা হয় না।
উচ্চ SGPT মাত্রা কমানোর উপায়
যদি আপনার SGPT-এর মাত্রা বেশি থাকে, তাহলে ডাক্তার আপনাকে কিছু পরামর্শ দিতে পারেন। নিচে কিছু সাধারণ উপায় আলোচনা করা হলো:
জীবনযাত্রার পরিবর্তন
- স্বাস্থ্যকর খাবার: প্রচুর ফল, সবজি এবং শস্য জাতীয় খাবার খান। ফাস্ট ফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য ব্যায়াম করুন।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন কমাতে চেষ্টা করুন।
- মদ্যপান পরিহার: মদ্যপান থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে থাকুন।
চিকিৎসা
- ডাক্তারের পরামর্শ: ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খান এবং নিয়মিত ফলো-আপ করুন।
- কারণ নির্ণয়: SGPT বাড়ার কারণ খুঁজে বের করে তার চিকিৎসা করা জরুরি।
ফ্যাটি লিভার এবং SGPT
ফ্যাটি লিভার একটি সাধারণ সমস্যা, যেখানে লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমে যায়। এর কারণে লিভারের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে এবং SGPT-এর মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। ফ্যাটি লিভারের দুইটি প্রধান প্রকার আছে: অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার (অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে) এবং নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার (অন্যান্য কারণে, যেমন – ডায়াবেটিস, স্থূলতা)।
ফ্যাটি লিভারের জন্য খাদ্য পরিকল্পনা
যদি আপনার ফ্যাটি লিভার থাকে, তাহলে সঠিক খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করা জরুরি। নিচে কিছু টিপস দেওয়া হলো:
- কম চর্বিযুক্ত খাবার: কম ফ্যাট যুক্ত খাবার গ্রহণ করুন এবং ভাজা খাবার এড়িয়ে চলুন।
- কম শর্করা যুক্ত খাবার: চিনি এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খান।
- ফাইবার যুক্ত খাবার: প্রচুর ফল, সবজি এবং শস্য জাতীয় খাবার খান।
- পর্যাপ্ত প্রোটিন: আপনার খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত প্রোটিন রাখুন।
লিভারের অন্যান্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা
SGPT ছাড়াও লিভারের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আরো কিছু টেস্ট করা হয়। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ টেস্টের নাম দেওয়া হলো:
- SGOT/AST: এই এনজাইমও লিভারের কোষে পাওয়া যায়। লিভারের ক্ষতির পরিমাণ জানতে এই টেস্ট করা হয়।
- ALP (ক্ষারীয় ফসফেটেজ): এটি লিভার এবং হাড়ের স্বাস্থ্য জানতে সাহায্য করে।
- বিলিরুবিন: এটি লিভারের দ্বারা তৈরি একটি রঞ্জক পদার্থ। জন্ডিসের কারণ নির্ণয় করতে এই টেস্ট করা হয়।
- লিভার বায়োপসি: প্রয়োজনে লিভারের টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা করা হয়।
SGPT এবং ALT এর মধ্যে পার্থক্য
SGPT এবং ALT একই এনজাইম। SGPT হলো এই এনজাইমের পুরনো নাম, আর ALT হলো আধুনিক নাম। দুটো নামই রক্তের এই এনজাইমের মাত্রাকে নির্দেশ করে, যা লিভারের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়।
জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে লিভারকে সুস্থ রাখার টিপস
লিভারকে সুস্থ রাখতে কিছু সাধারণ নিয়মকানুন মেনে চলা উচিত। নিচে কিছু টিপস দেওয়া হলো:
- পর্যাপ্ত জল পান করুন: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা লিভারের জন্য খুব জরুরি।
- নিয়মিত শরীরচর্চা: নিয়মিত ব্যায়াম লিভারের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ: স্বাস্থ্যকর খাবার লিভারকে সুস্থ রাখে।
- অতিরিক্ত ওষুধ পরিহার: অপ্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: বছরে একবার অন্তত লিভারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত।
শেষ কথা
SGPT টেস্ট লিভারের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লিভারের কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত এই টেস্টের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা শুরু করা যায়। তাই, নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিন এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলুন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন!
যদি আপনার মনে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আপনার স্বাস্থ্য বিষয়ক যে কোনো জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে আমি সবসময় প্রস্তুত।
