H. PYLORI টেস্ট কেন করা হয়: পাকস্থলী পরীক্ষা
পেটের সমস্যা এখন ঘরে ঘরে। আর এই সমস্যার পেছনে অনেক সময় লুকিয়ে থাকে এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া, যার নাম এইচ. পাইলোরি (H. pylori)। তাই, এইচ. পাইলোরি টেস্ট কেন করা হয়, পাকস্থলী পরীক্ষা নিয়ে আজকের আলোচনা।
যদি আপনার প্রায়ই পেটে ব্যথা করে, গ্যাস হয়, বা হজমে সমস্যা হয়, তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য। এখানে আমরা আলোচনা করব এইচ. পাইলোরি কী, কেন এই টেস্ট করানো দরকার, এবং এই টেস্টের মাধ্যমে কী জানা যায়।
এইচ. পাইলোরি (H. pylori) কী?
এইচ. পাইলোরি হল এক প্রকারের ব্যাকটেরিয়া, যা মানুষের পাকস্থলীতে বাসা বাঁধে। এটি পাকস্থলীর ভেতরের দেওয়ালে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা থেকে আলসার (Ulcer) পর্যন্ত হতে পারে। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষের শরীরে এই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। তবে, সবার ক্ষেত্রে এটি সমস্যা তৈরি করে না।
কীভাবে ছড়ায় এই জীবাণু?
এইচ. পাইলোরি সাধারণত দূষিত খাবার ও জলের মাধ্যমে ছড়ায়। এছাড়া, আক্রান্ত ব্যক্তির লালা থেকেও এটি ছড়াতে পারে। তাই, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকাটা খুব জরুরি।
এইচ. পাইলোরি টেস্ট কেন করা হয়?
পেটের কিছু সমস্যা দেখলে ডাক্তার H. Pylori টেস্ট করার পরামর্শ দেন। নিচে কয়েকটি কারণ আলোচনা করা হলো:
- পেটে ব্যথা: যদি আপনার পেটে প্রায়ই ব্যথা করে, বিশেষ করে খাবার খাওয়ার পরে বা রাতে, তাহলে ডাক্তার এই টেস্ট করাতে বলতে পারেন।
- বমি বমি ভাব: অনেকের বমি বমি ভাব বা বমি হওয়ার সমস্যা থাকে। সেক্ষেত্রেও এই টেস্ট দরকার হতে পারে।
- অম্বল বা গ্যাস: অতিরিক্ত অম্বল বা গ্যাস হওয়াও এইচ. পাইলোরি সংক্রমণের লক্ষণ হতে পারে।
- আলসারের সন্দেহ: পাকস্থলীতে আলসার হয়েছে কিনা, তা জানার জন্য এই টেস্ট করা হয়।
- বদহজম: খাবার হজম না হওয়া বা বদহজমের সমস্যা থাকলে এই টেস্ট করানো উচিত।
টেস্ট না করালে কী হতে পারে?
যদি সময় মতো এইচ. পাইলোরি ধরা না পরে, তাহলে এটি আলসার এবং পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই, পেটের সমস্যাকে অবহেলা করা উচিত নয়।
পাকস্থলী পরীক্ষার প্রকারভেদ
এইচ. পাইলোরি শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা রয়েছে। আপনার জন্য কোনটি উপযুক্ত, তা ডাক্তারই ভালো বলতে পারবেন। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা নিচে দেওয়া হলো:
- রক্ত পরীক্ষা: এই পরীক্ষায় রক্তের মাধ্যমে এইচ. পাইলোরির অ্যান্টিবডি (Antibody) পরীক্ষা করা হয়।
- মল পরীক্ষা: মলের নমুনা (Stool Sample) নিয়ে এইচ. পাইলোরির উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।
- শ্বাস পরীক্ষা: এই পরীক্ষায় বিশেষ ধরণের তরল পান করার পরে শ্বাস পরীক্ষা করা হয়, যা থেকে এইচ. পাইলোরির উপস্থিতি বোঝা যায়। একে ইউরিয়া ব্রেথ টেস্টও (Urea Breath Test) বলা হয়।
- এন্ডোস্কোপি: এই পদ্ধতিতে একটি নলের মধ্যে ক্যামেরা ঢুকিয়ে পাকস্থলী সরাসরি দেখা হয় এবং প্রয়োজনে সেখান থেকে কিছু টিস্যু (Biopsy) নিয়ে পরীক্ষা করা হয়।
কোন পরীক্ষার ফল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য?
সাধারণত, মল পরীক্ষা এবং শ্বাস পরীক্ষাকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করা হয়। তবে, এন্ডোস্কোপি আরও বেশি তথ্য দিতে পারে, বিশেষ করে যদি আলসারের সন্দেহ থাকে।
এইচ. পাইলোরি পরীক্ষার প্রস্তুতি
টেস্টের আগে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলা জরুরি। যেমন:
- কিছু ওষুধ বন্ধ রাখা: ডাক্তার আপনাকে কিছু ওষুধ, যেমন – অ্যান্টাসিড (Antacid) বা ব্যথানাশক ওষুধ, কয়েক দিনের জন্য বন্ধ রাখতে বলতে পারেন।
- খাবার গ্রহণ: পরীক্ষার আগে কয়েক ঘণ্টা কিছু না খেয়ে থাকা ভালো।
- ধূমপান পরিহার: পরীক্ষার আগে ধূমপান করা উচিত নয়।
পরীক্ষার সময় কী হয়?
- রক্ত পরীক্ষা: সাধারণ রক্ত নেওয়ার মতোই এই পরীক্ষা করা হয়।
- মল পরীক্ষা: আপনাকে একটি পাত্রে মলের নমুনা সংগ্রহ করতে বলা হবে।
- শ্বাস পরীক্ষা: আপনাকে একটি বিশেষ তরল পান করতে দেওয়া হবে, তারপর একটি ব্যাগে শ্বাস ফেলতে হবে।
- এন্ডোস্কোপি: এই পরীক্ষায় আপনাকে অজ্ঞান (Sedation) করা হতে পারে, যাতে আপনি কোনো ব্যথা না পান।
ফলাফল এবং চিকিৎসা
টেস্টের ফলাফল পজিটিভ (Positive) এলে বুঝতে হবে আপনার শরীরে এইচ. পাইলোরি আছে। সেক্ষেত্রে ডাক্তার আপনাকে অ্যান্টিবায়োটিক (Antibiotic) এবং অ্যাসিড কমানোর ওষুধ দেবেন। সাধারণত, দুই সপ্তাহের মধ্যে এই চিকিৎসা শেষ হয়।
চিকিৎসার পর কী করা উচিত?
চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর আবার পরীক্ষা করে দেখা হয় যে ব্যাকটেরিয়া সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়েছে কিনা। এছাড়া, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন আনাও জরুরি।
জীবনযাত্রায় পরিবর্তন
কিছু নিয়ম মেনে চললে এইচ. পাইলোরি সংক্রমণ থেকে বাঁচা যায় এবং পেটের সমস্যাও কমানো যায়:
- স্বাস্থ্যকর খাবার: প্রচুর ফল, সবজি এবং ফাইবার (Fiber) যুক্ত খাবার খান।
- পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা: খাবার আগে ভালো করে হাত ধুয়ে নিন।
- ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার: এই অভ্যাসগুলো পাকস্থলীর জন্য ক্ষতিকর।
- নিয়মিত ব্যায়াম: ব্যায়াম করলে হজম ভালো হয় এবং শরীর সুস্থ থাকে।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
এইচ. পাইলোরি নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
এইচ. পাইলোরি কি ছোঁয়াচে?
হ্যাঁ, এইচ. পাইলোরি ছোঁয়াচে। এটি দূষিত খাবার, জল এবং লালার মাধ্যমে ছড়াতে পারে। তাই, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা জরুরি।
এই ব্যাকটেরিয়া কি ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে?
দীর্ঘদিন ধরে এইচ. পাইলোরি সংক্রমণ থাকলে পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। তবে, সঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে এই ঝুঁকি কমানো যায়।
গর্ভাবস্থায় এই টেস্ট করানো কি নিরাপদ?
গর্ভাবস্থায় রক্ত পরীক্ষা, মল পরীক্ষা এবং শ্বাস পরীক্ষা নিরাপদ। তবে, এন্ডোস্কোপি করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
শিশুদের মধ্যে এইচ. পাইলোরি সংক্রমণ কতটা সাধারণ?
উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে শিশুদের মধ্যে এই সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। অপরিষ্কার পরিবেশে থাকার কারণে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়।
চিকিৎসা চলাকালীন কী কী খাবার এড়িয়ে চলা উচিত?
চিকিৎসা চলাকালীন ভাজা খাবার, ফাস্ট ফুড, এবং অ্যাসিডিক (যেমন – টক জাতীয়) খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
প্রতিরোধের উপায় কি?
- নিয়মিত এবং সঠিকভাবে হাত ধোয়া: খাবার আগে এবং টয়লেট ব্যবহারের পরে ভাল করে হাত ধুতে হবে।
- নিরাপদ খাদ্য ও জল গ্রহণ: দূষিত খাবার ও জল এড়িয়ে চলতে হবে।
- উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা: পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
শেষ কথা
পেটের যে কোনো সমস্যাকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। যদি আপনার উপরে দেওয়া লক্ষণগুলো দেখা যায়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী এইচ. পাইলোরি টেস্ট করান। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন!
