FNAC টেস্ট কী: ফাইন নিডল অ্যাসপিরেশন পরীক্ষা

শারীরিক কোনো সমস্যা হলে আমরা ডাক্তারের কাছে যাই, তাই তো? ডাক্তার তখন রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন টেস্ট করতে বলেন। এর মধ্যে অনেক সময় FNAC টেস্ট করার প্রয়োজনও হতে পারে। কিন্তু FNAC টেস্ট জিনিসটা আসলে কী, কেন করা হয়, তা নিয়ে আমাদের অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগে। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা FNAC (Fine Needle Aspiration Cytology) টেস্ট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। FNAC টেস্ট কী, কখন প্রয়োজন হয়, কীভাবে করা হয় এবং এর সুবিধা-অসুবিধাগুলো কী কী – সবকিছুই সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলব, যাতে আপনি সহজেই এই পরীক্ষা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পান।

FNAC টেস্ট কী? ফাইন নিডল অ্যাসপিরেশন পরীক্ষা

FNAC-এর পুরো নাম হল ফাইন নিডল অ্যাসপিরেশন সাইটোলজি (Fine Needle Aspiration Cytology)। এটা এক ধরনের বায়োপসি (Biopsy) টেস্ট। বায়োপসি মানে হল শরীরের কোনো অংশ থেকে কোষ বা টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা করা। FNAC-তে একটি সরু সুঁই (Needle) ব্যবহার করে শরীরের কোনো সন্দেহজনক স্থান থেকে কোষ সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই কোষগুলো মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করে দেখা হয় যে, সেখানে কোনো রোগ আছে কিনা।

FNAC টেস্ট তুলনামূলকভাবে সহজ, দ্রুত এবং কম খরচযুক্ত একটি পরীক্ষা। এটি সাধারণত শরীরের বিভিন্ন ফোলা অংশ, যেমন – লিম্ফ নোড (Lymph node), থাইরয়েড (Thyroid), স্তন (Breast) অথবা অন্য কোনো সন্দেহজনক স্থান থেকে কোষ নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।

কেন FNAC টেস্ট করা হয়?

FNAC টেস্ট বিভিন্ন কারণে করা হতে পারে। নিচে কয়েকটি প্রধান কারণ আলোচনা করা হল:

  • টিউমার বা ফোলা অংশের কারণ নির্ণয়: শরীরের কোনো অংশে টিউমার বা ফোলা দেখা দিলে, সেটি ক্যান্সার কিনা অথবা অন্য কোনো কারণে হয়েছে, তা জানার জন্য এই পরীক্ষা করা হয়।
  • সংক্রমণ (Infection) নির্ণয়: কোনো সংক্রমণ হয়েছে কিনা এবং সেটি কী ধরনের সংক্রমণ, তা জানার জন্য FNAC টেস্ট করা হয়।
  • সিস্ট (Cyst) পরীক্ষা: সিস্ট হল তরল পদার্থ ভর্তি থলি। FNAC-এর মাধ্যমে সিস্ট থেকে তরল বের করে পরীক্ষা করা হয়, যাতে বোঝা যায় সেটি ক্ষতিকর কিনা।
  • লিম্ফ নোড (Lymph node) পরীক্ষা: লিম্ফ নোডগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অংশ। এগুলো ফুলে গেলে বা বড় হয়ে গেলে FNAC করে দেখা হয় যে, কোনো সংক্রমণ বা ক্যান্সারের কারণে এমন হয়েছে কিনা।
  • থাইরয়েড (Thyroid) গ্রন্থি পরীক্ষা: থাইরয়েড গ্রন্থিতে কোনো সমস্যা হলে, যেমন – নোডুল (Nodule) হলে, FNAC করে সেটি ক্যান্সার কিনা তা পরীক্ষা করা হয়।

FNAC টেস্ট কিভাবে করা হয়?

FNAC টেস্ট সাধারণত ডাক্তারের চেম্বার বা প্যাথলজি ল্যাবে করা হয়। এটি একটি সহজ প্রক্রিয়া এবং সাধারণত ১৫-৩০ মিনিট সময় লাগে। নিচে FNAC করার পদ্ধতিটি ধাপে ধাপে আলোচনা করা হল:

  1. প্রস্তুতি:

    • প্রথমে, রোগীকে পরীক্ষার টেবিলে শুতে বা বসতে বলা হয়।
    • যে স্থানে FNAC করা হবে, সেটি পরিষ্কার করে জীবাণুমুক্ত (Sterilize) করা হয়।
  2. অ্যানেস্থেশিয়া (Anesthesia):

    • সাধারণত FNAC করার সময় লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া (Local anesthesia) ব্যবহার করা হয়। এর ফলে ঐ স্থানটি সাময়িকভাবে অসাড় হয়ে যায় এবং রোগী ব্যথা অনুভব করেন না। তবে, অনেক ক্ষেত্রে অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়াই এই পরীক্ষা করা হয়।
  3. কোষ সংগ্রহ:

    • ডাক্তার একটি সরু সুঁই (Needle) ব্যবহার করে ফোলা বা টিউমারের মধ্যে প্রবেশ করান।
    • তারপর সিরিঞ্জের মাধ্যমে কোষ বা তরল টেনে নেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াটি কয়েকবার করা হতে পারে, যাতে যথেষ্ট সংখ্যক কোষ সংগ্রহ করা যায়।
  4. স্মিয়ার (Smear) তৈরি:

    • সংগ্রহ করা কোষগুলো একটি কাঁচের স্লাইডে (Glass slide) রাখা হয় এবং সেগুলোকে ভালোভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। একে স্মিয়ার তৈরি করা বলে।
  5. নমুনা পাঠানো:

    • তৈরি করা স্লাইডগুলো পরীক্ষাগারে (Laboratory) পাঠানো হয়, যেখানে সাইটোপ্যাথলজিস্ট (Cytopathologist) মাইক্রোস্কোপের নিচে কোষগুলো পরীক্ষা করেন।

FNAC টেস্টের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়?

FNAC টেস্টের জন্য বিশেষ কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। তবে, কিছু সাধারণ বিষয় খেয়াল রাখা ভালো:

  • ডাক্তারকে আপনার বর্তমান স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এবং আগে কোনো রোগ হয়ে থাকলে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানান।
  • যদি আপনি কোনো ওষুধ খেয়ে থাকেন, বিশেষ করে রক্ত পাতলা করার ওষুধ (যেমন – অ্যাসপিরিন বা ওয়ারফারিন), তাহলে অবশ্যই ডাক্তারকে জানান।
  • পরীক্ষার আগে কয়েক ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে হতে পারে, তবে এটি নির্ভর করে আপনার ডাক্তারের পরামর্শের উপর।
  • মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিন এবং ভয় পাবেন না। এটি একটি সাধারণ এবং নিরাপদ প্রক্রিয়া।

FNAC টেস্টের সুবিধা

FNAC টেস্টের অনেক সুবিধা রয়েছে, যা এটিকে রোগ নির্ণয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি করে তুলেছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা আলোচনা করা হল:

  • কম আক্রমণাত্মক (Less Invasive): FNAC একটি কম আক্রমণাত্মক প্রক্রিয়া। এতে কোনো বড় ধরনের কাটা-ছেঁড়া বা সার্জারির প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র একটি সরু সুঁই ব্যবহার করা হয়।
  • দ্রুত ফল: FNAC টেস্টের ফল সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যেই পাওয়া যায়। ফলে দ্রুত রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করা যায়।
  • কম খরচ: অন্যান্য বায়োপসি পদ্ধতির তুলনায় FNAC অনেক কম খরচযুক্ত। তাই এটি সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য।
  • বহির্বিভাগে করা যায়: FNAC সাধারণত ডাক্তারের চেম্বার বা প্যাথলজি ল্যাবে করা যায়। এর জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হয় না।
  • কম জটিলতা: FNAC করার সময় জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কিছু ক্ষেত্রে সামান্য রক্তপাত বা ব্যথা হতে পারে, যা সাধারণত অল্প সময়েই সেরে যায়।

FNAC টেস্টের অসুবিধা

FNAC টেস্টের কিছু অসুবিধা রয়েছে, যা আপনার জানা দরকার। নিচে কয়েকটি অসুবিধা উল্লেখ করা হল:

  • ১০০% নির্ভুল নয়: FNAC সবসময় ১০০% নির্ভুল ফলাফল দিতে পারে না। কারণ, সুঁই দিয়ে অল্প সংখ্যক কোষ সংগ্রহ করা হয়। ফলে অনেক সময় সঠিক রোগ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে।
  • ফলস নেগেটিভ (False Negative) হওয়ার সম্ভাবনা: কখনও কখনও ক্যান্সার থাকা সত্ত্বেও FNAC রিপোর্টে তা ধরা নাও পড়তে পারে। একে ফলস নেগেটিভ বলা হয়।
  • ফলস পজিটিভ (False Positive) হওয়ার সম্ভাবনা: খুব কম ক্ষেত্রে, FNAC রিপোর্টে ক্যান্সার না থাকা সত্ত্বেও ক্যান্সার ধরা পড়তে পারে। একে ফলস পজিটিভ বলা হয়।
  • নন-ডায়াগনস্টিক নমুনা: অনেক সময় পর্যাপ্ত কোষ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না, যার কারণে সঠিক রোগ নির্ণয় করা যায় না।

FNAC টেস্টের ঝুঁকি

FNAC টেস্ট সাধারণত নিরাপদ, তবে কিছু ঝুঁকি থাকতে পারে। নিচে কয়েকটি সম্ভাব্য ঝুঁকি আলোচনা করা হল:

  • রক্তপাত: সুঁই প্রবেশ করানোর স্থানে সামান্য রক্তপাত হতে পারে। সাধারণত এটি নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়।
  • সংক্রমণ: খুব কম ক্ষেত্রে, সুঁই প্রবেশ করানোর স্থানে সংক্রমণ হতে পারে। তাই পরীক্ষা করার আগে স্থানটি ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করা জরুরি।
  • ব্যথা: FNAC করার সময় বা পরে সামান্য ব্যথা হতে পারে। ব্যথানাশক ওষুধ (Painkiller) খেলে এই ব্যথা কমে যায়।
  • স্নায়ু বা রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া: খুব বিরল ক্ষেত্রে, সুঁইয়ের কারণে স্নায়ু বা রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

FNAC টেস্টের ফলাফল

FNAC টেস্টের ফলাফল সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যে পাওয়া যায়। ফলাফল পাওয়ার পর আপনার ডাক্তার আপনাকে বিস্তারিত জানাবেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে পরামর্শ দেবেন। ফলাফলে যা যা থাকতে পারে:

  • বিনাইন (Benign): এর মানে হল কোষে কোনো ক্যান্সার নেই। ফোলা বা টিউমারটি ক্যান্সারের নয়।
  • ম্যালিগন্যান্ট (Malignant): এর মানে হল কোষে ক্যান্সার আছে। এক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন।
  • সন্দেহজনক (Suspicious): এর মানে হল কোষে কিছু অস্বাভাবিকতা আছে, তবে সেটি ক্যান্সার কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আরও কিছু পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে।
  • নন-ডায়াগনস্টিক (Non-diagnostic): এর মানে হল পর্যাপ্ত কোষ সংগ্রহ করা যায়নি বা কোষগুলো পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত নয়। এক্ষেত্রে আবার FNAC করার প্রয়োজন হতে পারে।

FNAC টেস্টের বিকল্প

FNAC টেস্টের বিকল্প হিসেবে আরও কিছু পরীক্ষা করা যেতে পারে, যা রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে। নিচে কয়েকটি বিকল্প পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা করা হল:

  • কোর বায়োপসি (Core Biopsy): কোর বায়োপসিতে FNAC-এর চেয়ে একটু মোটা সুঁই ব্যবহার করা হয় এবং বেশি টিস্যু সংগ্রহ করা হয়। এর ফলে রোগ নির্ণয়ের সম্ভাবনা বাড়ে।
  • এক্সিসনাল বায়োপসি (Excisional Biopsy): এই পদ্ধতিতে পুরো টিউমার বা ফোলা অংশটি কেটে ফেলে দেওয়া হয় এবং তারপর সেটি পরীক্ষা করা হয়।
  • ইনসিশনাল বায়োপসি (Incisional Biopsy): এই পদ্ধতিতে টিউমারের একটি অংশ কেটে নিয়ে পরীক্ষা করা হয়।
  • ইমেজিং টেস্ট (Imaging Test): আলট্রাসাউন্ড (Ultrasound), সিটি স্ক্যান (CT scan) বা এমআরআই (MRI) এর মাধ্যমে শরীরের ভেতরের ছবি দেখে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়।

FNAC টেস্ট নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)

FNAC টেস্ট নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হল:

  • FNAC টেস্ট কি বেদনাদায়ক?

    FNAC করার সময় সামান্য ব্যথা লাগতে পারে, তবে এটি সাধারণত খুব বেশি বেদনাদায়ক নয়। প্রয়োজনে লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া ব্যবহার করা হয়, যাতে আপনি কোনো ব্যথা অনুভব না করেন।

  • FNAC টেস্টের পর কি বিশ্রাম প্রয়োজন?

    FNAC টেস্টের পর সাধারণত বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না। আপনি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারেন। তবে, যদি সুঁই প্রবেশ করানোর স্থানে ব্যথা থাকে, তাহলে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে পারেন।

  • FNAC টেস্টের রিপোর্ট পেতে কত দিন লাগে?

    FNAC টেস্টের রিপোর্ট সাধারণত ২-৭ দিনের মধ্যে পাওয়া যায়। এটি নির্ভর করে পরীক্ষাগারের কর্মব্যস্ততার উপর।

  • FNAC টেস্ট কি ক্যান্সারের বিস্তার ঘটাতে পারে?

    FNAC টেস্টের মাধ্যমে ক্যান্সারের বিস্তার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এটি একটি নিরাপদ প্রক্রিয়া।

  • FNAC করার আগে কি কোনো ওষুধ বন্ধ করতে হয়?

    যদি আপনি রক্ত পাতলা করার ওষুধ (যেমন – অ্যাসপিরিন বা ওয়ারফারিন) খেয়ে থাকেন, তাহলে FNAC করার আগে আপনার ডাক্তারকে জানানো উচিত। তিনি হয়তো সাময়িকভাবে ওষুধ বন্ধ করার পরামর্শ দিতে পারেন।

উপসংহার

FNAC টেস্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, যা শরীরের বিভিন্ন ফোলা বা টিউমারের কারণ জানতে সাহায্য করে। এটি কম আক্রমণাত্মক, দ্রুত এবং তুলনামূলকভাবে কম খরচযুক্ত একটি পরীক্ষা। তবে, এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং সবসময় ১০০% নির্ভুল ফলাফল পাওয়া যায় না। FNAC করার আগে আপনার ডাক্তারের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করে এই পরীক্ষার সুবিধা, অসুবিধা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে জেনে নেওয়া উচিত।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *