ESR কীসের টেস্ট: প্রদাহ পরিমাপ বোঝা

আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন आपनी?

শরীরের ভেতরের খবর জানতে চান? তাহলে ESR (এরিথ্রোসাইট সেডিমেন্টেশন রেট) টেস্টের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন! ESR কী, কেন করা হয়, আর এর ফলাফলই বা কী ইঙ্গিত দেয় – এইসব নিয়ে আজকের আলোচনা।

ESR কী?

ESR হলো Erythrocyte Sedimentation Rate। সহজ ভাষায়, আপনার রক্ত কত দ্রুত জমাট বাঁধে, সেটাই মাপা হয় এই টেস্টের মাধ্যমে। "এরিথ্রোসাইট" মানে লোহিত রক্ত কণিকা, আর "সেডিমেন্টেশন" মানে থিতানো বা জমা হওয়া। রক্তের মধ্যে লোহিত রক্ত কণিকাগুলো কত দ্রুত টেস্টটিউবের নিচে জমা হচ্ছে, তা দেখেই বোঝা যায় শরীরে কোনো প্রদাহ (inflammation) আছে কিনা।

ESR কেন করা হয়?

ESR কোনো রোগ নির্ণয় করার জন্য সরাসরি করা হয় না। বরং এটা একটা নির্দেশক, যা শরীরের কোনো সমস্যার জানান দেয়। ডাক্তাররা সাধারণত নিম্নলিখিত কারণে ESR টেস্ট করার পরামর্শ দেন:

  • প্রদাহ (Inflammation) নির্ণয়: শরীরে কোনো প্রদাহ আছে কিনা, তা জানতে এই টেস্ট করা হয়। প্রদাহের কারণে ESR-এর মাত্রা বেড়ে যায়।
  • রোগের তীব্রতা জানতে: কিছু রোগের ক্ষেত্রে, যেমন – অটোইমিউন রোগ (যেমন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস), সংক্রমণ (ইনফেকশন), অথবা ক্যান্সারের তীব্রতা জানতে এই পরীক্ষা করা হয়।
  • চিকিৎসার কার্যকারিতা মূল্যায়ন: কোনো প্রদাহজনিত রোগের চিকিৎসা চললে, তা কতটা কার্যকরী হচ্ছে, তা জানার জন্য ESR টেস্ট করা হয়।

ESR টেস্ট কিভাবে করা হয়?

ESR টেস্ট খুবই সাধারণ এবং দ্রুত করা যায়। সাধারণত এই পদ্ধতিতে রক্ত পরীক্ষার জন্য আপনার হাতের नस থেকে অল্প পরিমাণ রক্ত নেওয়া হয়।

  1. রক্ত সংগ্রহ: প্রথমে আপনার হাতের উপরের অংশের চামড়া অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। তারপর একটি সিরিঞ্জ ব্যবহার করে সামান্য রক্ত নেওয়া হয়।
  2. নমুনা প্রক্রিয়াকরণ: সংগৃহীত রক্ত একটি বিশেষ টিউবে রাখা হয়, যাতে জমাট বাঁধা বন্ধ করার উপাদান (anticoagulant) মেশানো থাকে।
  3. পরিমাপ: টিউবটি একটি উল্লম্ব স্ট্যান্ডে এক ঘণ্টার জন্য রাখা হয়। এই সময়ে, লোহিত রক্তকণিকাগুলো ধীরে ধীরে টিউবের নিচে জমা হতে শুরু করে।
  4. ফলাফল: এক ঘণ্টা পর, টিউবের উপরে রক্তের জলীয় অংশ (প্লাজমা)-এর স্তর মাপা হয়। এই স্তর যত বেশি হবে, ESR-এর মান তত বেশি। এই মান মিলিমিটার প্রতি ঘণ্টায় (mm/hr) প্রকাশ করা হয়।

ESR স্বাভাবিক মাত্রা কত?

ESR-এর স্বাভাবিক মাত্রা বয়স এবং লিঙ্গের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে:

গ্রুপ স্বাভাবিক মাত্রা (mm/hr)
পুরুষ 0-15
মহিলা 0-20
শিশু 0-10

তবে, এই মাত্রাগুলো একেক ল্যাবরেটরিতে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। তাই আপনার রিপোর্টের রেফারেন্স রেঞ্জটি দেখে নেওয়া ভালো।

ESR বাড়ার কারণগুলো কী কী?

ESR বাড়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। কিছু সাধারণ কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:

  • সংক্রমণ (Infection): যে কোনো ধরনের সংক্রমণ, যেমন – শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, মূত্রনালীর সংক্রমণ, বা ত্বকের সংক্রমণে ESR বাড়তে পারে।
  • অটোইমিউন রোগ: রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, লুপাস, ইত্যাদি অটোইমিউন রোগে ESR বাড়ে।
  • প্রদাহজনিত রোগ: ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ (IBD) বা অন্য কোনো প্রদাহজনিত রোগে ESR বাড়তে পারে।
  • ক্যান্সার: কিছু ক্ষেত্রে ক্যান্সার, যেমন – লিম্ফোমা, মাল্টিপল মায়লোমা, ইত্যাদি কারণে ESR বাড়তে পারে।
  • অন্যান্য কারণ: গর্ভাবস্থা, অ্যানিমিয়া, থাইরয়েড রোগ, কিডনির রোগ এবং কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও ESR বাড়তে পারে।

ESR কম থাকার কারণগুলো কী কী?

ESR কম থাকাটা খুব একটা চিন্তার কারণ নয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন হতে পারে। ESR কমার কিছু কারণ হলো:

  • পলিসাইথেমিয়া: এই রোগে রক্তের কোষের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়।
  • সিকল সেল অ্যানিমিয়া: এই রোগে লোহিত রক্ত কণিকার আকার পরিবর্তিত হয়ে যায়।
  • লিভারের রোগ: কিছু লিভারের রোগে ESR কম থাকতে পারে।
  • কিছু ঔষধ: কিছু ঔষধ, যেমন – NSAIDs (নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস) ESR কমাতে পারে।

ESR বেশি হলে কী করণীয়?

ESR বেশি হলে আপনার ডাক্তার এর কারণ খুঁজে বের করার জন্য আরও কিছু পরীক্ষা করতে পারেন। ESR শুধু একটি নির্দেশক, তাই এর ওপর ভিত্তি করে কোনো চিকিৎসা শুরু করা উচিত নয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী, রোগের কারণ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন।

ESR পরীক্ষার আগে কী প্রস্তুতি নিতে হয়?

সাধারণত ESR পরীক্ষার জন্য বিশেষ কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। তবে কিছু বিষয় মনে রাখা ভালো:

  • ডাক্তারকে আপনার বর্তমান স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এবং আপনি কী কী ওষুধ খাচ্ছেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানান।
  • কিছু ওষুধ ESR-এর মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই পরীক্ষার আগে ওষুধ বন্ধ করার প্রয়োজন হলে, ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
  • সাধারণত এই পরীক্ষার জন্য উপোস থাকার প্রয়োজন হয় না। তবে আপনার ডাক্তার যদি অন্য কোনো পরামর্শ দেন, তা মেনে চলুন।

ESR এবং CRP-এর মধ্যে পার্থক্য কী?

ESR এবং CRP (C-reactive protein) দুটোই শরীরে প্রদাহের উপস্থিতি নির্দেশ করে। তবে এদের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে:

বৈশিষ্ট্য ESR CRP
প্রদাহের সংবেদনশীলতা কম সংবেদনশীল বেশি সংবেদনশীল
দ্রুত পরিবর্তন ধীরে পরিবর্তন হয় দ্রুত পরিবর্তন হয়
কারণ অনেক কারণে বাড়তে পারে প্রদাহের কারণে বাড়ে
ব্যবহার দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহের জন্য ভালো তীব্র প্রদাহের জন্য ভালো

CRP হলো তীব্র প্রদাহের একটি ভালো নির্দেশক, যা খুব দ্রুত ওঠানামা করে। অন্যদিকে, ESR ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয় এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহের জন্য বেশি উপযোগী।

ESR টেস্টের সুবিধা ও অসুবিধা

ESR টেস্টের কিছু সুবিধা ও অসুবিধা নিচে উল্লেখ করা হলো:

সুবিধা:

  • সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী।
  • শরীরে প্রদাহের উপস্থিতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়।
  • অন্যান্য পরীক্ষার সাথে মিলিয়ে রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে।

অসুবিধা:

  • এটি কোনো নির্দিষ্ট রোগ নির্ণয় করতে পারে না।
  • অনেক কারণে ESR-এর মাত্রা বাড়তে বা কমতে পারে, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
  • CRP-এর চেয়ে কম সংবেদনশীল।

জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে ESR-এর মাত্রা কিভাবে কমাবেন?

যদিও ESR কোনো রোগ নয়, বরং রোগের নির্দেশক, তবুও কিছু জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে প্রদাহ কমিয়ে ESR-এর মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। নিচে কিছু টিপস দেওয়া হলো:

  1. স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ: তাজা ফল, সবজি, শস্য এবং প্রোটিন খাবারের তালিকায় যোগ করুন। প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিনি এবং ট্রান্স ফ্যাট এড়িয়ে চলুন।
  2. নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য ব্যায়াম করুন। এটি আপনার শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করবে।
  3. ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন শরীরের প্রদাহ বাড়াতে পারে। তাই সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  4. ধূমপান পরিহার: ধূমপান শরীরের প্রদাহ বৃদ্ধি করে। ধূমপান ত্যাগ করে আপনি আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারেন।
  5. পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ঘুম শরীরকে পুনরায় সক্রিয় করে তোলে এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
  6. মানসিক চাপ কমানো: যোগা, মেডিটেশন বা শখের কাজ করার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো যায়। অতিরিক্ত মানসিক চাপ শরীরের প্রদাহ বাড়ায়।

ESR নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ):

এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা ESR নিয়ে আপনার আরও অনেক দ্বিধা দূর করবে।

ESR কি ক্যান্সার নির্দেশ করে?

ESR ক্যান্সার নির্দেশ করতে পারে, তবে সবসময় নয়। ESR বাড়ার অনেক কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে ক্যান্সার একটি। ক্যান্সার ছাড়াও সংক্রমণ, প্রদাহজনিত রোগ, অটোইমিউন রোগ এবং অন্যান্য কারণেও ESR বাড়তে পারে। যদি আপনার ESR বেশি থাকে, তবে ডাক্তার আরও কিছু পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবেন যে এর কারণ ক্যান্সার কিনা।

ESR স্বাভাবিক থাকার মানে কি আমি সুস্থ?

ESR স্বাভাবিক থাকার মানে এই নয় যে আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ। ESR শুধু প্রদাহের একটি নির্দেশক। অনেক রোগ আছে যেখানে ESR স্বাভাবিক থাকতে পারে, কিন্তু অন্য উপসর্গ দেখা যায়। তাই, যদি আপনার কোনো শারীরিক সমস্যা থাকে, তবে ESR স্বাভাবিক থাকলেও ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

আমি কি বাড়িতে ESR পরীক্ষা করতে পারি?

না, বাড়িতে ESR পরীক্ষা করার কোনো উপায় নেই। ESR পরীক্ষা করার জন্য ল্যাবরেটরির প্রয়োজন হয়, যেখানে প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ানরা বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করে এই পরীক্ষা করেন।

ESR পরীক্ষার খরচ কেমন?

ESR পরীক্ষার খরচ সাধারণত ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। তবে, স্থান এবং ল্যাবরেটরি ভেদে এই খরচ ভিন্ন হতে পারে।

ESR রিপোর্ট পেতে কতদিন লাগে?

ESR রিপোর্ট সাধারণত ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পাওয়া যায়। কিছু ল্যাবরেটরি দ্রুত রিপোর্ট সরবরাহ করে, আবার কিছু ক্ষেত্রে একটু বেশি সময় লাগতে পারে।

ESR বেশি হলে কি অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হবে?

ESR বেশি হলে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হবে কিনা, তা নির্ভর করে ESR বাড়ার কারণের ওপর। যদি ESR কোনো ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের কারণে বেড়ে থাকে, তবে ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন। তবে, ESR বাড়ার কারণ যদি অন্য কিছু হয়, তবে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নাও হতে পারে। তাই, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।

গর্ভাবস্থায় ESR বাড়লে কি কোনো সমস্যা হবে?

গর্ভাবস্থায় ESR সামান্য বাড়তে পারে, যা স্বাভাবিক। গর্ভাবস্থায় শরীরে অনেক ধরনের পরিবর্তন হয়, যার কারণে ESR-এর মাত্রায় পরিবর্তন দেখা যায়। তবে, ESR-এর মাত্রা খুব বেশি বাড়লে বা অন্য কোনো উপসর্গ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

শিশুদের ক্ষেত্রে ESR-এর স্বাভাবিক মাত্রা কত?

শিশুদের ক্ষেত্রে ESR-এর স্বাভাবিক মাত্রা সাধারণত 0-10 mm/hr হয়ে থাকে। তবে, এই মাত্রা ল্যাবরেটরি ভেদে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। আপনার সন্তানের ESR রিপোর্ট দেখার সময় রেফারেন্স রেঞ্জটি দেখে নিন।

আশা করি, ESR নিয়ে আপনার মনে থাকা অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছি। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

শেষ কথা

ESR কী, কেন করা হয়, এবং এর ফলাফল কী মানে দাঁড়ায়, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। মনে রাখবেন, ESR কোনো রোগ নির্ণয়ের জন্য সরাসরি পরীক্ষা নয়, বরং এটি একটি নির্দেশক মাত্র। আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে যেকোনো উদ্বেগের জন্য সবসময় ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *