ডেঙ্গু টেস্ট কী কী: নির্ণয় পদ্ধতি জানুন
ডেঙ্গু! এই নামটা শুনলেই যেন জ্বর, গা-হাত পায়ে ব্যথা আর ক্লান্তিতে মনটা ভরে যায়, তাই না? বাংলাদেশে ডেঙ্গু একটি পরিচিত সমস্যা। কিন্তু ডেঙ্গু হয়েছে কিনা, তা জানার জন্য কী কী টেস্ট করা হয়, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে। তাই আজ আমরা আলোচনা করব ডেঙ্গু টেস্ট কী কী এবং এর নির্ণয় পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে।
ডেঙ্গু শুধু একটি রোগ নয়, এটি একটি আতঙ্কের নাম। মশা বাহিত এই রোগটি প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। সময় মতো সঠিক পরীক্ষা এবং চিকিৎসা না করালে এটি মারাত্মক রূপ নিতে পারে। তাই ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং এর লক্ষণগুলো জানা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।
ডেঙ্গু টেস্ট: প্রকারভেদ ও কখন কোনটা জরুরি?
ডেঙ্গু হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাধারণত কয়েকটি টেস্ট করা হয়ে থাকে। এই টেস্টগুলো বিভিন্ন সময়ে করা হয় এবং এদের কাজও ভিন্ন ভিন্ন। আসুন, এই টেস্টগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক:
১. এনএস১ (NS1) অ্যান্টিজেন টেস্ট
এনএস১ অ্যান্টিজেন টেস্ট ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম দিকে করা হয়। জ্বর হওয়ার প্রথম পাঁচ দিনের মধ্যে এই টেস্ট করালে সঠিক ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এনএস১ অ্যান্টিজেন টেস্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ?
- ভাইরাস শনাক্তকরণ: এই টেস্টের মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া যায়।
- দ্রুত নির্ণয়: জ্বরের শুরুতেই এই টেস্ট করালে দ্রুত রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়।
- তাৎক্ষণিক চিকিৎসা: দ্রুত রোগ নির্ণয় করা গেলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়।
২. ডেঙ্গু আইজিএম (IgM) এবং আইজিজি (IgG) অ্যান্টিবডি টেস্ট
ডেঙ্গু আইজিএম এবং আইজিজি অ্যান্টিবডি টেস্ট সাধারণত জ্বরের পাঁচ দিন পর করা হয়। এই টেস্টের মাধ্যমে শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি সনাক্ত করা হয়।
আইজিএম এবং আইজিজি অ্যান্টিবডি টেস্টের তাৎপর্য
- সংক্রমণের পর্যায়: আইজিএম অ্যান্টিবডি সাধারণত সাম্প্রতিক সংক্রমণ নির্দেশ করে, যেখানে আইজিজি অ্যান্টিবডি পুরনো সংক্রমণ অথবা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়া বোঝায়।
- রোগ নির্ণয়: এই টেস্টের মাধ্যমে ডেঙ্গু সংক্রমণের পর্যায় নির্ণয় করা যায়।
- ভ্যাকসিন কার্যকারিতা: আইজিজি অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা যায়।
৩. পিসিআর (PCR) টেস্ট
পিসিআর ( Polymerase Chain Reaction ) টেস্ট একটি আধুনিক এবং নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা। এই টেস্টের মাধ্যমে রক্তের মধ্যে ডেঙ্গু ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান খুঁজে বের করা হয়।
পিসিআর টেস্টের সুবিধা
- নির্ভুল ফলাফল: পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে প্রায় নির্ভুল ফলাফল পাওয়া যায়।
- ভাইরাসের পরিমাণ নির্ণয়: এই টেস্টের মাধ্যমে শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ জানা যায়, যা রোগের তীব্রতা বুঝতে সাহায্য করে।
- early detection : এই টেস্টের মাধ্যমে খুব early disease detection করা সম্ভব।
৪. সিবিসি (CBC) বা কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট
সিবিসি বা কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট ডেঙ্গু নির্ণয়ের জন্য সরাসরি কোনো পরীক্ষা নয়, তবে এটি রোগীকে পর্যবেক্ষণ করতে সহায়ক। এই পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের বিভিন্ন উপাদান, যেমন – শ্বেত রক্ত কণিকা ( white blood cell ), লোহিত রক্ত কণিকা ( red blood cell ) এবং প্লেটলেট ( platelet ) এর সংখ্যা জানা যায়। ডেঙ্গু হলে অনেক সময় প্লেটলেট কাউন্ট কমে যায়, তাই এই পরীক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ।
সিবিসি কেন প্রয়োজন?
- প্লেটলেট গণনা: ডেঙ্গু হলে প্লেটলেট কমে গেলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ে। সিবিসি প্লেটলেটের সংখ্যা জানতে সাহায্য করে।
- অন্যান্য জটিলতা নির্ণয়: সিবিসি পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের অন্যান্য উপাদানগুলোর অবস্থা জেনে ডেঙ্গুর কারণে হওয়া জটিলতাগুলো সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
কোন টেস্ট কখন করবেন?
জ্বর হওয়ার প্রথম দিকে এনএস১ অ্যান্টিজেন টেস্ট করা উচিত, কারণ এই সময়ে ভাইরাসের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি থাকে। জ্বরের পাঁচ দিন পর আইজিএম এবং আইজিজি অ্যান্টিবডি টেস্ট করা ভালো, কারণ এই সময়ে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে শুরু করে। পিসিআর টেস্ট যেকোনো সময় করা যায়, তবে এটি সাধারণত রোগ নির্ণয়ের প্রাথমিক পর্যায়ে বেশি কার্যকর।
কোথায় করবেন এই পরীক্ষাগুলো?
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি অনেক হাসপাতালেই ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও, বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতেও এই পরীক্ষাগুলো করা যায়। তবে, পরীক্ষা করানোর আগে অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে নিন যে সেই প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান রয়েছে।
ডেঙ্গু পরীক্ষার খরচ কেমন?
ডেঙ্গু পরীক্ষার খরচ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভিন্ন হতে পারে। সাধারণত, এনএস১ অ্যান্টিজেন টেস্টের খরচ ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। আইজিএম এবং আইজিজি অ্যান্টিবডি টেস্টের খরচ ১০০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। পিসিআর টেস্টের খরচ সাধারণত ২০০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। সিবিসি বা কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট এর খরচ ৫০০-৮০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।
ফ্রিকোয়েন্টলি আস্কড কোশ্চেনস (FAQ)
ডেঙ্গু নিয়ে আপনাদের মনে আসা কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং তার উত্তর নিচে দেওয়া হলো:
১. ডেঙ্গু কি শুধু একবারই হয়?
না, ডেঙ্গু একবারের বেশিও হতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ভিন্ন সেরোটাইপ (DENV-1, DENV-2, DENV-3, DENV-4) রয়েছে। তাই, একবার একটি সেরোটাইপ দিয়ে সংক্রমিত হলে, অন্য সেরোটাইপগুলো দিয়ে আবারও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। দ্বিতীয়বার বা তার বেশি ডেঙ্গু হলে জটিলতা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
২. ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কী কী?
ডেঙ্গু জ্বরের প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
- জ্বর (সাধারণত ১০২-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট)
- তীব্র মাথাব্যথা
- চোখের পেছনে ব্যথা
- শরীরে র্যাশ
- হাড় এবং মাংসপেশিতে ব্যথা
- বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
৩. ডেঙ্গু হলে কি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি?
সব ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি নয়। তবে, কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে, যেমন –
- শরীরে পানিশূন্যতা
- প্লেটলেট কাউন্ট অনেক কমে গেলে
- রক্তচাপ কমে গেলে
- অন্যান্য জটিলতা দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন হতে পারে।
৪. ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায় কী?
ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো মশা নিয়ন্ত্রণ করা। এর জন্য:
- ঘর এবং आसपास পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন।
- জমা पानी সরান।
- মশার স্প্রে ব্যবহার করুন।
- দিনের বেলায় ঘুমানোর সময়ও মশারী ব্যবহার করুন।
৫. ডেঙ্গু কি একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায়?
ডেঙ্গু সরাসরি একজন মানুষ থেকে অন্যজনে ছড়ায় না। এটি ছড়ায় মশার মাধ্যমে। যখন কোনো মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন সেই মশা ভাইরাস বহন করে এবং অন্য সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে সে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়।
৬. ডেঙ্গু থেকে সেরে উঠতে কত দিন লাগে?
সাধারণত, ডেঙ্গু জ্বর সেরে উঠতে ৭ থেকে ১০ দিন লাগে। তবে, দুর্বলতা এবং ক্লান্তি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে।
৭. ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য কি উপোস থাকা লাগে?
ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য সাধারণত উপোস থাকার প্রয়োজন হয় না। তবে, আপনার চিকিৎসক যদি অন্য কোনো পরীক্ষার সাথে এই পরীক্ষা করতে বলেন, তবে সেক্ষেত্রে কিছু নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হতে পারে।
৮. ডেঙ্গু হলে কি প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে?
ডেঙ্গু হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যায়, তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী। অতিরিক্ত প্যারাসিটামল লিভারের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ পরিহার করা উচিত, কারণ এগুলো রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
৯. ডেঙ্গু রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা কি আছে?
ডেঙ্গু রোগের কোনো নির্দিষ্ট ঘরোয়া চিকিৎসা নেই। তবে, প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার গ্রহণ করা, বিশ্রাম নেওয়া এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা জরুরি।
১০. ডেঙ্গু কি মারাত্মক হতে পারে?
হ্যাঁ, ডেঙ্গু মারাত্মক হতে পারে, বিশেষ করে যদি সময় মতো চিকিৎসা না করা হয়। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS) এর মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে, যা জীবন হানিকর হতে পারে।
ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে কিছু অতিরিক্ত টিপস
- ফুলহাতা জামাকাপড় পরিধান করুন, বিশেষ করে যখন মশার উপদ্রব বেশি থাকে।
- জানালা এবং দরজায় মশারোধী জাল ব্যবহার করুন।
- বাড়ির আশেপাশে মশা ডিম পাড়তে পারে এমন জায়গাগুলো পরিষ্কার রাখুন।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান এবং কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
শেষ কথা
ডেঙ্গু একটি серьез রোগ, তবে সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে এটি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তাই, ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতন থাকুন, প্রতিরোধের उपायগুলো অনুসরণ করুন এবং প্রয়োজনে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
মনে রাখবেন, আপনার একটু সতর্কতা এবং সচেতনতাই পারে আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে ডেঙ্গুর হাত থেকে রক্ষা করতে। ডেঙ্গু নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকলে, নির্দ্বিধায় আপনার স্বাস্থ্যকর্মীর সাথে যোগাযোগ করুন।
