জন্ডিস টেস্টের খরচ কত: লিভার স্বাস্থ্য পরীক্ষা

জন্ডিস! নামটা শুনলেই কেমন যেন গা শিউরে ওঠে, তাই না? চোখের সাদা অংশ আর চামড়া যখন হলদে হয়ে যায়, তখন চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর চিন্তা হবেই না কেন, জন্ডিস তো লিভারের সমস্যার একটা বড় লক্ষণ। কিন্তু আসল কথা হল, জন্ডিস হয়েছে কিনা, সেটা জানতে তো আগে পরীক্ষা করাতে হবে, তাই না? আর সেই পরীক্ষার খরচ কেমন, সেটাই তো আজকের আলোচনার বিষয়!

জন্ডিস টেস্টের খরচ নিয়ে অনেকের মনেই অনেক প্রশ্ন ঘোরাফেরা করে। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা সেই সব প্রশ্নের উত্তর দেব, যাতে আপনি আপনার লিভারের স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পান। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!

জন্ডিস টেস্ট কেন জরুরি?

জন্ডিস নিজে কোনো রোগ নয়, এটা রোগের লক্ষণ। আমাদের রক্তে বিলিরুবিন (Bilirubin) নামের একটা পিগমেন্টের মাত্রা বেড়ে গেলে জন্ডিস হয়। বিলিরুবিন তৈরি হয় যখন আমাদের শরীরের পুরনো লোহিত রক্তকণিকা ভাঙে। লিভারের কাজ হল এই বিলিরুবিনকে শরীর থেকে বের করে দেওয়া। কিন্তু লিভার যদি কোনো কারণে দুর্বল হয়ে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বিলিরুবিন জমতে শুরু করে, আর তখনই জন্ডিসের লক্ষণ দেখা যায়।

জন্ডিস কেন হয়, তার কিছু কারণ নিচে দেওয়া হল:

  • ভাইরাল সংক্রমণ (যেমন হেপাটাইটিস এ, বি, সি)
  • অ্যালকোহল বা মদ্যপান
  • লিভার সিরোসিস
  • পিত্তথলির সমস্যা
  • কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
  • জন্মগত ত্রুটি

জন্ডিসের লক্ষণগুলো চট করে দেখে নেওয়া যাক:

  • ত্বক ও চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া
  • গাঢ় রঙের প্রস্রাব
  • হালকা রঙের পায়খানা
  • ক্লান্তি ও দুর্বলতা
  • পেটে ব্যথা
  • বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
  • ক্ষুধা কমে যাওয়া

যদি আপনার মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখা যায়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ, সঠিক সময়ে জন্ডিসের চিকিৎসা না করালে লিভারের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

জন্ডিস নির্ণয়ের জন্য কি কি টেস্ট করা হয়?

জন্ডিস হয়েছে কিনা, সেটা জানার জন্য ডাক্তার সাধারণত কিছু ব্লাড টেস্ট (Blood Test) করার পরামর্শ দেন। এই টেস্টগুলো লিভারের স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দেয়। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ টেস্টের নাম দেওয়া হল:

  • বিলিরুবিন টেস্ট (Bilirubin Test): এই টেস্টের মাধ্যমে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা মাপা হয়। বিলিরুবিনের মাত্রা বেশি থাকলে জন্ডিসের সম্ভাবনা থাকে।
  • লিভার ফাংশন টেস্ট (Liver Function Test – LFT): এই টেস্টের মাধ্যমে লিভারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। লিভারের এনজাইম যেমন এসজিপিটি (SGPT), এসজিওটি (SGOT), অ্যালকালাইন ফসফাটেজ (ALP) এবং অ্যালবুমিনের মাত্রা দেখা হয়।
  • হেপাটাইটিস স্ক্রিনিং (Hepatitis Screening): জন্ডিসের কারণ যদি ভাইরাল সংক্রমণ হয়, তাহলে এই টেস্টের মাধ্যমে হেপাটাইটিস এ, বি, সি ভাইরাস শনাক্ত করা যায়।
  • কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (Complete Blood Count – CBC): এই টেস্টের মাধ্যমে রক্তের বিভিন্ন কোষের সংখ্যা জানা যায়, যা জন্ডিসের কারণ নির্ণয়ে সাহায্য করে।
  • আলট্রাসনোগ্রাফি (Ultrasonography): পেটের আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে লিভার, পিত্তথলি এবং অন্যান্য অঙ্গের ছবি দেখা যায়, যা জন্ডিসের কারণ খুঁজে বের করতে সাহায্য করে।

এই টেস্টগুলো ছাড়াও, রোগীর অবস্থা অনুযায়ী ডাক্তার আরও কিছু স্পেশাল টেস্টের পরামর্শ দিতে পারেন।

জন্ডিস টেস্টের খরচ: কোথায় কত?

জন্ডিস টেস্টের খরচ বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের উপর নির্ভর করে। সাধারণত, সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে খরচ একটু বেশি হয়। নিচে বিভিন্ন টেস্টের আনুমানিক খরচ দেওয়া হল:

টেস্টের নাম আনুমানিক খরচ (টাকা)
বিলিরুবিন টেস্ট (Bilirubin Test) ২৫০ – ৫০০
লিভার ফাংশন টেস্ট (LFT) ৮০০ – ১৫০০
হেপাটাইটিস স্ক্রিনিং ১৫০০ – ৩০০০
কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (CBC) ৫০০ – ৮০০
আলট্রাসনোগ্রাফি ১০০০ – ২০০০

এই খরচগুলো আনুমানিক, তাই টেস্ট করানোর আগে ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সঠিক মূল্য জেনে নেওয়াই ভালো।

বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে জন্ডিস টেস্টের খরচ

ঢাকার কয়েকটি জনপ্রিয় ডায়াগনস্টিক সেন্টারে জন্ডিস টেস্টের খরচ নিচে দেওয়া হল:

  • পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার: এখানে লিভার ফাংশন টেস্টের খরচ প্রায় ১২০০-১৫০০ টাকা। বিলিরুবিন টেস্টের খরচ প্রায় ৩০০-৪০০ টাকা।
  • ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার: এখানে লিভার ফাংশন টেস্টের খরচ প্রায় ১৩০০-১৬০০ টাকা। বিলিরুবিন টেস্টের খরচ প্রায় ৩৫০-৪৫০ টাকা।
  • ডায়াগনস্টিক সেন্টার: এখানে লিভার ফাংশন টেস্টের খরচ প্রায় ১০০০-১২০০ টাকা। বিলিরুবিন টেস্টের খরচ প্রায় ২৫০-৩৫০ টাকা।

খরচ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানার জন্য, আপনি সরাসরি ঐ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে যোগাযোগ করতে পারেন।

সরকারি হাসপাতালে জন্ডিস টেস্টের খরচ

সরকারি হাসপাতালে জন্ডিস টেস্টের খরচ বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে অনেক কম হয়। তবে, সরকারি হাসপাতালে কিছু টেস্ট বিনামূল্যেও করা যায়। সরকারি হাসপাতালে সাধারণত বিলিরুবিন টেস্টের খরচ ১০০-২০০ টাকা এবং লিভার ফাংশন টেস্টের খরচ ৫০০-৮০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।

খরচ কমানোর উপায়

জন্ডিস টেস্টের খরচ কমাতে চাইলে আপনি কিছু উপায় অবলম্বন করতে পারেন:

  • সরকারি হাসপাতাল: সরকারি হাসপাতালে টেস্ট করালে খরচ অনেক কম হয়।
  • প্যাকেজ: কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার জন্ডিস টেস্টের জন্য বিশেষ প্যাকেজ দিয়ে থাকে। এই প্যাকেজগুলোতে খরচ কিছুটা কম হতে পারে।
  • ডিসকাউন্ট: কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার বিভিন্ন সময়ে ডিসকাউন্ট অফার করে। সেই সময় টেস্ট করালে খরচ কমানো সম্ভব।

জন্ডিস থেকে বাঁচতে কিছু টিপস

জন্ডিস থেকে বাঁচতে হলে লিভারের যত্ন নেওয়া খুব জরুরি। নিচে কিছু টিপস দেওয়া হল, যা আপনার লিভারকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে:

  • স্বাস্থ্যকর খাবার: স্বাস্থ্যকর খাবার খান এবং ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন।
  • অ্যালকোহল পরিহার: অ্যালকোহল লিভারের জন্য ক্ষতিকর, তাই এটি পরিহার করুন।
  • নিয়মিত ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম করলে লিভারের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
  • পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন।
  • ডাক্তারের পরামর্শ: কোনো সমস্যা হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)

জন্ডিস নিয়ে আপনার মনে আরও কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হল:

জন্ডিস কি ছোঁয়াচে?

ভাইরাল হেপাটাইটিস (যেমন হেপাটাইটিস এ) ছোঁয়াচে হতে পারে। তবে, সব ধরনের জন্ডিস ছোঁয়াচে নয়।

জন্ডিস হলে কি কি খাবার খাওয়া উচিত?

জন্ডিস হলে সহজে হজম হয় এমন খাবার খাওয়া উচিত। যেমন –

  • ফল ও সবজি
  • ডাল
  • খিচুড়ি
  • কম তেল মসলার খাবার

জন্ডিস হলে কি কি খাবার খাওয়া উচিত না?

জন্ডিস হলে কিছু খাবার পরিহার করা উচিত। যেমন –

  • ভাজা খাবার
  • ফাস্ট ফুড
  • অতিরিক্ত তেল মসলার খাবার
  • অ্যালকোহল

জন্ডিসের ঘরোয়া চিকিৎসা কি আছে?

জন্ডিসের ঘরোয়া চিকিৎসা হিসেবে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং প্রচুর পরিমাণে জল পান করা জরুরি। তবে, ঘরোয়া চিকিৎসার পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াও আবশ্যক।

লিভার ভালো রাখার জন্য কি কি খাবার খাওয়া উচিত?

লিভার ভালো রাখার জন্য কিছু খাবার বিশেষভাবে উপকারী। যেমন –

  • সবুজ শাকসবজি
  • ফল (আপেল, পেঁপে, কমলা)
  • আদা ও রসুন
  • গ্রিন টি
  • কমলালেবুর রস

জন্ডিস সেরে যেতে কতদিন লাগে?

জন্ডিস সেরে যেতে সাধারণত ২-৮ সপ্তাহ সময় লাগে। তবে, এটা নির্ভর করে জন্ডিসের কারণ এবং তীব্রতার উপর।

শিশুদের জন্ডিস হলে কি করব?

নবজাতক শিশুদের জন্ডিস হওয়াটা খুবই সাধারণ ঘটনা। তবে, যদি জন্ডিসের মাত্রা খুব বেশি হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

জন্ডিস কি মারাত্মক হতে পারে?

হ্যাঁ, জন্ডিস মারাত্মক হতে পারে যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হয়।

শেষ কথা

জন্ডিস একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, এর সঠিক চিকিৎসা করানো জরুরি। আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি আপনাকে জন্ডিস এবং এর টেস্টের খরচ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দিতে পেরেছে। আপনার লিভারের স্বাস্থ্য সম্পর্কে যদি কোনো সন্দেহ থাকে, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন!

যদি আপনার এই বিষয়ে আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমি চেষ্টা করব আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে। আর হ্যাঁ, এই ব্লগ পোস্টটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *