ইউরিন টেস্ট কত প্রকার: বিভিন্ন পরীক্ষার তথ্য

আমাদের শরীরটা একটা জটিল যন্ত্রের মতো, আর এই যন্ত্রের ভেতরের খবর জানতে মাঝে মাঝেই কিছু পরীক্ষার দরকার পড়ে। তেমনই একটা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হল ইউরিন টেস্ট।

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, "ইউরিন টেস্ট কত প্রকার?" বা "কিডনি পরীক্ষার জন্য ইউরিন টেস্ট কি কি?" আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা ইউরিন টেস্টের বিভিন্ন প্রকারভেদ, কেন এই পরীক্ষাগুলো করা হয়, এবং এই সম্পর্কিত কিছু জরুরি তথ্য নিয়ে আলোচনা করব।

তাহলে চলুন, দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক ইউরিন টেস্টের খুঁটিনাটি।

ইউরিন টেস্ট কি এবং কেন করা হয়?

ইউরিন টেস্ট, যাকে আমরা প্রস্রাব পরীক্ষা নামেও চিনি, শরীরের স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে। প্রস্রাবের রং, গন্ধ, এবং উপাদান দেখে অনেক রোগ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

  • কিডনির অবস্থা জানতে
  • ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে
  • লিভারের সমস্যা নির্ণয় করতে
  • ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI) পরীক্ষা করতে
  • প্রেগন্যান্সি টেস্ট করতে

এছাড়াও, আরও অনেক কারণে ডাক্তাররা এই পরীক্ষাটি করার পরামর্শ দেন।

ইউরিন টেস্ট কত প্রকার? (Types of Urine Tests)

বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন ধরনের ইউরিন টেস্ট করা হয়ে থাকে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইউরিন টেস্ট নিয়ে আলোচনা করা হলো:

রুটিন ইউরিন টেস্ট (Routine Urine Test)

রুটিন ইউরিন টেস্ট হল সবচেয়ে সাধারণ ইউরিন টেস্ট। এটি সাধারণত স্বাস্থ্য পরীক্ষার অংশ হিসেবে করা হয়। এই পরীক্ষায় প্রস্রাবের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন – রং, ঘনত্ব, অম্লতা (pH), এবং কিছু বিশেষ উপাদান (যেমন – প্রোটিন, গ্লুকোজ, শ্বেত রক্ত কণিকা, ইত্যাদি) পরীক্ষা করা হয়।

রুটিন ইউরিন টেস্ট কেন করা হয়?

  • শারীরিক অবস্থা সাধারণভাবে জানার জন্য।
  • কোনো রোগের প্রাথমিক লক্ষণ সনাক্ত করার জন্য।
  • চিকিৎসার কার্যকারিতা নিরীক্ষণের জন্য।

ইউরিন কালচার (Urine Culture)

ইউরিন কালচার টেস্টের মাধ্যমে প্রস্রাবের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ আছে কিনা, তা দেখা হয়। যদি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়, তাহলে কোন অ্যান্টিবায়োটিক সেগুলোর উপর কাজ করবে, সেটাও এই টেস্টের মাধ্যমে জানা যায়।

ইউরিন কালচার কেন করা হয়?

  • ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI) নির্ণয় করার জন্য।
  • বারবার ইউটিআই হওয়া থেকে বাঁচাতে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক নির্বাচন করার জন্য।

ইউরিন প্রোটিন টেস্ট (Urine Protein Test)

এই পরীক্ষায় প্রস্রাবের মধ্যে প্রোটিনের মাত্রা মাপা হয়। সাধারণত, প্রস্রাবে প্রোটিন থাকার কথা নয়। কিন্তু কিডনির সমস্যা হলে প্রস্রাবের মাধ্যমে প্রোটিন বের হতে পারে।

ইউরিন প্রোটিন টেস্ট কেন করা হয়?

  • কিডনি রোগ নির্ণয় করার জন্য।
  • ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনির ক্ষতি হয়েছে কিনা, তা জানার জন্য।
  • প্রি-এক্লাম্পসিয়া (Pre-eclampsia) নামক গর্ভাবস্থার জটিলতা নির্ণয় করার জন্য।

ইউরিন গ্লুকোজ টেস্ট (Urine Glucose Test)

এই পরীক্ষায় প্রস্রাবের মধ্যে গ্লুকোজের মাত্রা মাপা হয়। সাধারণত, প্রস্রাবে গ্লুকোজ থাকার কথা নয়। কিন্তু ডায়াবেটিস হলে বা কিডনির কিছু সমস্যা থাকলে প্রস্রাবের মাধ্যমে গ্লুকোজ বের হতে পারে।

ইউরিন গ্লুকোজ টেস্ট কেন করা হয়?

  • ডায়াবেটিস নির্ণয় করার জন্য।
  • গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস (Gestational diabetes) পরীক্ষা করার জন্য।
  • কিডনির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করার জন্য।

ইউরিন সাইটোলজি (Urine Cytology)

এই পরীক্ষায় প্রস্রাবের মধ্যে অস্বাভাবিক কোষ (যেমন – ক্যান্সার কোষ) আছে কিনা, তা দেখা হয়।

ইউরিন সাইটোলজি কেন করা হয়?

  • মূত্রাশয় (Bladder) বা কিডনির ক্যান্সার নির্ণয় করার জন্য।
  • অন্যান্য ক্যান্সার স্ক্রিনিং করার জন্য।

২৪ ঘণ্টার ইউরিন কালেকশন (24-Hour Urine Collection)

এই পরীক্ষায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের (সাধারণত ২৪ ঘণ্টা) মধ্যে শরীর থেকে নির্গত হওয়া পুরো প্রস্রাব সংগ্রহ করা হয় এবং তা পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষাটি কিছু বিশেষ রোগ নির্ণয় করার জন্য করা হয়।

২৪ ঘণ্টার ইউরিন কালেকশন কেন করা হয়?

  • কিডনি পাথর (Kidney stone) হওয়ার কারণ নির্ণয় করার জন্য।
  • কিছু হরমোনের মাত্রা (যেমন – কর্টিসল) মাপার জন্য।
  • শরীরে প্রোটিনের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য।

ড্রাগ স্ক্রিনিং (Drug Screening)

এই পরীক্ষার মাধ্যমে প্রস্রাবে কোনো অবৈধ মাদক দ্রব্য অথবা ঔষধের উপস্থিতি আছে কিনা, তা পরীক্ষা করা হয়।

ড্রাগ স্ক্রিনিং কেন করা হয়?

  • চাকরির জন্য আবেদন করার সময়।
  • ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আগে।
  • আইনগত কারণে।
  • পুনর্বাসন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সময়।

ইউরিন টেস্ট কিভাবে করা হয়? (How is a Urine Test Done?)

ইউরিন টেস্ট করা খুবই সহজ। সাধারণত, আপনাকে একটি পরিষ্কার পাত্রে প্রস্রাব সংগ্রহ করতে বলা হবে। কিছু পরীক্ষার জন্য, আপনাকে "clean-catch" পদ্ধতি অনুসরণ করতে হতে পারে। এই পদ্ধতিতে প্রথমে আপনার যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করে, তারপর প্রস্রাবের প্রথম অংশের পরিবর্তে মাঝের অংশ সংগ্রহ করতে হয়।

২৪ ঘণ্টার ইউরিন কালেকশনের জন্য, আপনাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপনার শরীর থেকে নির্গত হওয়া সমস্ত প্রস্রাব একটি পাত্রে জমা করতে হবে এবং তা পরীক্ষাগারে জমা দিতে হবে।

ইউরিন টেস্টের আগে কি কি প্রস্তুতি নিতে হয়? (Preparations Before a Urine Test)

বেশিরভাগ ইউরিন টেস্টের জন্য বিশেষ কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। তবে কিছু ক্ষেত্রে, ডাক্তার আপনাকে পরীক্ষা করার আগে কিছু খাবার বা পানীয় এড়িয়ে চলতে বলতে পারেন। এছাড়াও, আপনি যদি কোনো ওষুধ গ্রহণ করেন, তবে সে বিষয়ে ডাক্তারকে জানানো উচিত, কারণ কিছু ওষুধ পরীক্ষার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।

  • ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী, কিছু ওষুধ বন্ধ করতে হতে পারে।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা উচিত, যদি না ডাক্তার অন্য কিছু বলে থাকেন।
  • মহিলাদের ক্ষেত্রে, মাসিকের সময় এই পরীক্ষা করা উচিত নয়, অথবা করলে ল্যাব টেকনিশিয়ানকে জানাতে হবে।

ইউরিন টেস্টের ফলাফল (Urine Test Results)

ইউরিন টেস্টের ফলাফল সাধারণত কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাওয়া যায়। কিছু বিশেষ পরীক্ষার ফলাফল পেতে কয়েক দিন লাগতে পারে। আপনার পরীক্ষার ফলাফল আপনার ডাক্তার আপনাকে বুঝিয়ে বলবেন। ফলাফলে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখলে, ডাক্তার আপনাকে আরও কিছু পরীক্ষা বা চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারেন।

ইউরিন টেস্ট সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্ন (Frequently Asked Questions – FAQs)

এখন আমরা ইউরিন টেস্ট নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর জেনে নেব:

ইউরিন পরীক্ষায় কি কি রোগ ধরা পরে?

ইউরিন পরীক্ষার মাধ্যমে অনেক রোগ সম্পর্কে জানতে পারা যায়, তার মধ্যে কয়েকটি হল:

  • ডায়াবেটিস
  • কিডনি রোগ
  • লিভারের সমস্যা
  • ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI)
  • কিছু ক্যান্সার

গর্ভাবস্থায় ইউরিন টেস্ট কেন করা হয়?

গর্ভাবস্থায় ইউরিন টেস্ট করা হয় মূলত গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational Diabetes), প্রি-এক্লাম্পসিয়া (Pre-eclampsia), এবং ইউরিন ইনফেকশন (UTI) এর মতো সমস্যাগুলো খুঁজে বের করার জন্য। এই সমস্যাগুলো মা ও বাচ্চা উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে।

ইউরিন ইনফেকশন টেস্ট কিভাবে করে?

ইউরিন ইনফেকশন (UTI) পরীক্ষা করার জন্য সাধারণত ইউরিন কালচার (Urine Culture) করা হয়। এই পরীক্ষায় প্রস্রাবের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয় এবং সংক্রমণ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া সনাক্ত করা হয়।

ইউরিন টেস্টের স্বাভাবিক মাত্রা কত?

ইউরিন টেস্টের স্বাভাবিক মাত্রা বিভিন্ন উপাদানের উপর নির্ভর করে এবং এটি পরীক্ষাগার ভেদে ভিন্ন হতে পারে। আপনার ইউরিন টেস্টের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর, ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে বিস্তারিত জেনে নিতে পারেন।

কিডনি পরীক্ষার জন্য ইউরিন টেস্ট কি কি?

কিডনি পরীক্ষার জন্য সাধারণত যে ইউরিন টেস্টগুলো করা হয়, সেগুলো হলো:

  • রুটিন ইউরিন টেস্ট
  • ইউরিন প্রোটিন টেস্ট
  • ২৪ ঘণ্টার ইউরিন কালেকশন
  • ইউরিন ক্রিয়েটিনিন টেস্ট

প্রস্রাবের সাথে রক্ত গেলে কি করনীয়?

প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া একটি গুরুতর লক্ষণ। এটি কিডনি সংক্রমণ, পাথর, টিউমার বা অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে হতে পারে। এই অবস্থায় দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

ইউরিন টেস্টের খরচ কত?

বিভিন্ন ইউরিন টেস্টের খরচ বিভিন্ন রকম হতে পারে, যা পরীক্ষাগার এবং পরীক্ষার ধরনের উপর নির্ভর করে। রুটিন ইউরিন টেস্টের খরচ সাধারণত কম হয়ে থাকে, তবে বিশেষ পরীক্ষার খরচ বেশি হতে পারে।

উপসংহার (Conclusion)

ইউরিন টেস্ট আমাদের শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে। রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্তকরণ এবং সঠিক চিকিৎসার জন্য এই পরীক্ষা অপরিহার্য। তাই, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ইউরিন টেস্ট করানো উচিত।

যদি আপনার ইউরিন টেস্ট নিয়ে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *